শিরোনাম

স্মৃতিময় রানা প্লাজা

মনডারে বোঝানোর জন্য প্রতিবছরই এমন দিনে রানা প্লাজার সামনে এসে ঘুরি-ফিরি, জুরাইন কবরস্থানে যাই। একবার এনাম হাসপাতালে গিয়েও ঘুরে আসি, যদি মেয়ের লাশের কোনো খোঁজ পাই। শেষবারের মতো মেয়ের মুখটা দেখার আশায় নির্জলা উপবাস করি, যদি ফিরে আসে। নাহ্! কেউ কিছু বলে না, কোনো তথ্য নেই কারও কাছে, মেয়ের কোনো কবরও নেই। একমুঠো মাটি পেলে ওইটাই আজীবন রেখে দিতাম নিজের কাছে।’
সুনামগঞ্জ এর রানী দাস,
হিন্দুধর্মাবলম্বী হয়েও মেয়ের খোঁজে এভাবেই কবরস্থানে এসে বসে থাকেন রুনা। কারণ, যাঁদের চিহ্নিত করা যায়নি, তাঁদের সবার আশ্রয় হয়েছে এখানে। দুই মেয়ে নিয়ে রুনা কাজ করতেন রানা প্লাজার ইথারটেক্সে। ভবনধসের দিন বড় মেয়ে সমাপ্তি কারখানা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। মাকে বলেছিল, ভয় করছে। কিন্তু ম্যানেজার মাইকে সবাইকে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে বলছিলেন, ‘ভয় নাই, সব ঠিক আছে।’ তারপরই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। ছোট মেয়েটাকে জাপটে ধরেছিলেন। কিন্তু বড় মেয়ে আর বের হতে পারেনি।
পাঁচ বছর আগে রানা প্লাজা ধসে যাঁরা প্রাণ হারান, তাঁরা এসেছিলেন একটা মানববন্ধনে অংশ নিতে। সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার সেই স্থানের সামনেই দেখা মিলল নিখোঁজ শান্তনা আক্তারের বোন সেলিনা আক্তারের সঙ্গে। দিনাজপুরের সেলিনা আক্তার তাঁর বোনের মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে মন্তব্য করে বলেন, শান্তনা নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগেই তাঁদের আরেক প্রতিবন্ধী বোন মারা যান। পরপর দুই বোনের মৃত্যু তাঁদের অসহায় করে তুলেছে। জীবিত না হোক, মৃত বোনটির লাশ তাঁরা চান।
একইভাবে ফরিদপুরের আলম মাতবর হারিয়েছেন তাঁর তিন সন্তানের মা বিউটি বেগমকে। বললেন, লাশটা পেলে অন্তত সন্তানদের নিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারতেন। আরও কথা হলো নিহত আয়শা খাতুন, হাসিনা বেগম, ফরিদা বেগম, জাহিদ শেখ, আনোয়ারা বেগম, সাইদুর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন, শায়লা আক্তার, বেলাল হোসেন, শারমীন হোসেন, মর্জিনা বেগমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরা সবাই প্রিয় স্বজনের লাশটা চান, দেখতে চান প্রিয়জনের কবর।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সব মিলিয়ে ১০৩ জনের লাশ এখনো শনাক্ত হয়নি। বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁদের জায়গা হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে। এসব লাশের পরিচয় পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেইও বলে জানা গেছে। পরিচয় অশনাক্ত রেখেই শেষ করা হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষা। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেওয়া নমুনার সঙ্গে মিল রেখে কবরে একটি শনাক্তকরণ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। ওই শনাক্তকরণ নম্বরপ্লেট মুছে গেছে। মুছে গেছে নামফলকও। গতকাল সোমবারও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা জুরাইনে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয়জনদের লাশ খুঁজতে। বেদনা নিয়ে আবারও ফিরে এসেছেন তাঁরা।
শ্রম মন্ত্রণালয়ে থাকা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রানা প্লাজা ধসের পর প্রথমে শনাক্ত না হওয়া ৩২২ জনের মধ্যে মোট ২০৬টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। পরে আরও চারজনের রক্তের নমুনা নিলে দুজনের ডিএনএর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৩২২টি নমুনা দেওয়া হলেও ১১ জনের নমুনা দুবার করে দেওয়া হয়েছিল।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খোন্দকার মোস্তান হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। না মিললে কী করার আছে। আমরা সব হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি। বারবার ডিএনএ টেস্ট করেছি। আমরা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। আর কিছু করার নেই।’
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রানা প্লাজায় নিহত নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের তাঁদের আশা ছেড়ে দেওয়াই উচিত। কেননা, মৃত অশনাক্ত ব্যক্তিদের ডিএনএ পরীক্ষা আর করা হবে না। ফলে বলা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতীক্ষার একধরনের অবসানই ঘটল।

No comments

Thanks for your comments. I will reply you as soon as.