কাজের শোভন পরিবেশের বিকল্প নেই
১৩২ বছর আগের ১ মে দিনটি ছিল শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সনদের দিন। আজ এত দিন পরও যখন ১ মে আমাদের সামনে সমাগত হয়, সে দিনটিও শ্রমিকের সত্যিকার অর্থে ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার আর্তি নিয়ে হাজির হওয়ার দিন। মে দিবস বিশ্বজুড়ে, দেশে দেশে এবং বাংলাদেশেও লাল পতাকার স্লোগান উচ্চকিত মিছিলের দিন।
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, কাজের পরিবেশ, শ্রম ব্যবস্থাপনা, কর্মরত অবস্থায় শ্রমিকের দুর্ঘটনার প্রকৃত ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ—আজও শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি নিয়েই ১ মে পথে নামে মেহনতি মজদুর মানুষেরা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশের শ্রমিকদের কাছে এ দিনটি আরও
গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, শ্রমিক অধিকার বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও একটি। আজও এ দেশের ব্যক্তিমালিকানার মিলকারখানায় মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলায় দোলে শ্রমিকদের ভাগ্য, এটি মে দিবসের আদর্শের এবং চেতনার বিপরীতমুখী চিত্র। তাই মে দিবসের মিছিলে শ্রমিকের স্লোগানে ১৩২ বছর পর আজও বিদ্রোহ ঝরে পড়ে।
আমরা আশ্বস্ত হতে পারি এই ভেবে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার আশাব্যঞ্জক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব শ্রমিকের হাত ধরে এই প্রবৃদ্ধি, সেই শ্রমিকদের শ্রম অধিকার আজ নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই একজন শ্রমিকের বেতন এবং তাঁর সংসারের ছোট একটি পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যেতে পারে।
একজন শ্রমিকের স্ত্রী, তাঁর দুটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে একজন ধরে নিলে শ্রমিকসহ ওই সংসারে মোট মানুষ তিনজন। বর্তমান বাজারদর হিসাবে প্রতিজনের পেছনে মাথাপিছু খাদ্য-খরচ ৩ হাজার—তিনজনের ক্ষেত্রে ৯ হাজার টাকা। ন্যূনতম হিসাবে খাদ্যদ্রব্যের বাইরে এই তিনজনের বাসাভাড়া, পোশাক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যাতায়াত ইত্যাদি আনুষঙ্গিক খরচ আরও ৯ হাজার। অর্থাৎ তাঁর পরিবারপিছু খরচ ১৮ হাজার টাকা। অথচ পোশাকশ্রমিকের বেতন মাত্র ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অর্থাৎ বাঁচার মতো ন্যূনতম মজুরি আজ সময়ের দাবি।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের জন্য সামান্য কিছু স্বস্তি থাকলেও ব্যক্তিমালিকানা খাতের এই সমীকরণটা আমাদের শ্রমজীবী মানুষের জন্য চরম বাস্তবতা। এই খাতের সংখ্যাই বেশি বলে এ দেশের সচেতন মানুষ এবং সুস্থধারার ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা বঞ্চিত, হতভাগ্য শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে সব সময়ই সোচ্চার। সাম্প্রতিক কালের রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি আর টঙ্গীর বিভিন্ন কারখানায় বিস্ফোরণ এবং আগুনে হতাহত মানুষের হাহাকার—পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার তাগিদের দাবি বারবার আমাদের আন্দোলিত করে।
আজকের মে দিবসের প্রাক্কালে সবার তাই নজর দেওয়া দরকার শোভন কাজের পরিবেশ তৈরির দিকে। কাজের সুষ্ঠু নীতিমালা, সুন্দর কর্মপরিবেশ এবং শক্তিশালী মজুরির হার—এগুলোই উৎপাদিত সামগ্রী রপ্তানিতে সেফগার্ডের ভূমিকা রাখবে, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। শোভন কাজের জন্য চাকরিস্থলের সহজলভ্যতা, আয়ের সুযোগ এবং প্রতিটি কাজের মানদণ্ড নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক নিরাপত্তাটি আজকের যুগে অধিকারের বিষয়ে স্বীকৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকের জন্য বড় প্রয়োজন হয়ে উঠেছে তাঁর কথা বলার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। এটিই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার।
ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পথ ধরে যেকোনো ইতিবাচক সমস্যার সমাধান সম্ভব। ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে শিল্প খাতে নানা রকম অরাজকতা এবং হিংসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে বিধায় আমরা মনে করি ট্রেড ইউনিয়ন এখন শিল্প বিকাশের অন্যতম চাবিকাঠি। শোভন কাজের পরিবেশ সৃষ্টি হলে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীভূত হয়ে দেশ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে শোভন কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে, এ দেশে অসংগঠিত খাতের শ্রমিকসংখ্যা অত্যধিক। এই শ্রমিকেরা যেমন সঠিকভাবে স্বীকৃত নন, তেমনি আইনের দ্বারাও সুরক্ষিত নন। আজ তাঁদের কথা, তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার কথা ভাবার সময় এসেছে। এঁদের সুরক্ষা দেওয়া না গেলে একদিকে যেমন আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না, অন্যদিকে শোভন কাজের পরিবেশও নিশ্চিত হবে না।
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের যুগে প্রবেশ করেছে। এ দেশে তাই কোনোরূপ ‘মজুরি দাসত্ব’-এর সুযোগ নেই, বাঞ্ছনীয় নয়। এই চেতনায় অসংগঠিত শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে স্থায়ী কাজের আওতায় আনতে হবে—দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ভূমিকা রাখবে আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে।
এটিই সত্যি যে ১৩২ বছর আগে সংঘটিত মে দিবস শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টির তাড়না জোগাতে বারে বারে ফিরে আসে, ফিরে আসে ‘শ্রমিক মানুষ’কে ‘সম্মানিত মানুষে’ প্রতিষ্ঠিত করতে।
=========================================================================================
No comments
Thanks for your comments. I will reply you as soon as.