রিদ্দার যুদ্ধ
রিদ্দার যুদ্ধ (Arabic: حروب الردة) খলিফা আবু বকরের শাসনামলে ৬৩২ থেকে ৬৩৩ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়। এ সময় বিদ্রোহী আরব গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। বিদ্রোহীদের বক্তব্য ছিল তারা মুহাম্মদ (সা) এর অনুগত ছিল কিন্তু আবু বকরকে তারা মানবে না। কিছু বিদ্রোহী তুলায়হা, মুসায়লিমা ও সাজাহর অনুসরণ শুরু করেছিল। এই তিন ব্যক্তি নিজেদের নবী দাবি করত। বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করে খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মক্কার আশেপাশের অধিবাসীরা বিদ্রোহ করেনি।
পূর্ব ঘটনা
৬৩২ সালের মে মাসে মুহাম্মদ (সা) রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযানের নির্দেশ দেন। ৩০০০ মুসলিম এতে যোগ দেয়। জায়েদ ইবনে হারিসার সন্তান উসামা ইবনে জায়েদকে এই সেনাদলের নেতৃত্ব দেয়া হয়। একই বছর জুন মাসে মুহাম্মদ (সা) মৃত্যুবরণ করেন ও আবু বকর তার খলিফা নির্বাচিত হন।
দায়িত্বগ্রহণের প্রথম দিন আবু বকর উসামা ইবনে জায়েদকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। আরবে বিদ্রোহ শুরু হওয়ায় আবু বকর অভিযানের ব্যাপারে চিন্তিত থাকলেও অনড় ছিলেন। অগ্রসর হওয়ার আগে উসামা ইবনে জায়েদ উমর ইবনুল খাত্তাবকে আবু বকরের কাছে পাঠান এবং বলেন:
খলিফার কাছে যান, তাকে বলুন যাতে সেনাদের মদিনায় অবস্থান করার অনুমতি দেয়া হয়। সব নেতা আমার সাথে রয়েছে। যদি আমরা চলে যাই তবে কাফিরদের মদিনাকে টুকরো করে ফেলা প্রতিহত করার মত কেউ থাকবে না।
তবে আবু বকর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। মুহাম্মদ (সা) অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করার ইচ্ছায় তিনি রয়ে যান।
৬৩২ সালের ২৬ জুন উসামার সেনারা এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। মদিনা ত্যাগের পর উসামা তাবুকের দিকে অগ্রসর হন। এখানকার অধিকাংশ গোত্র তীব্রভাবে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে আবু বকরের সেনাদের কাছে তারা পরাজিত হয়। উসামা উত্তর আরবের অনেক ভেতর পর্যন্ত অভিযান চালান। তিনি কুজা থেকে শুরু করে দুমাতুল জান্দালের দিকে এগিয়ে যান।
তার অভিযানের সরাসরি ফলাফল হিসেবে কিছু বিদ্রোহী গোত্র মদিনার আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে। কুজা বিদ্রোহী থেকে যায়। এরপর আমর ইবনুল আস সেখানে আক্রমণ করেন এবং তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন।
এরপর উসামা মুতার দিকে অগ্রসর হন এবং বনু কালব ও গাসানীয় খ্রিষ্টান আরবদের আক্রমণ করেন। এরপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দী ও সম্পদসহ তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। সেনারা ৪০ দিনের জন্য মদিনার বাইরে ছিল।
মদিনার প্রতিরক্ষা
মদিনার নিকটস্থ বিদ্রোহীরা দুইটি স্থানে সমবেত ছিল। এর একটি হল মদিনার ৭২ মাইল উত্তর পূর্বে আবরাক ও ২৪ মাইল পূর্বে যুকিসা। বনু গাতাফান, হাওয়াজিন ও তায়ি গোত্র এতে নিয়োজিত ছিল। আবু বকর প্রতিপক্ষ গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের প্রতি অনুগত ও জাকাত প্রদান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন।
উসামার বাহিনী যাত্রা করার এক বা দুই সপ্তাহ পর লড়াই করার জন্য অল্প সেনা আছে জানতে পেরে বিদ্রোহী গোত্রগুলো মদিনাকে ঘিরে ফেলে। ইতিমধ্যে স্বঘোষিত নবী তুলায়হা যুকিসার বিদ্রোহীদের শক্তিবৃদ্ধি করে। ৬৩২ সালের জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে বিদ্রোহী সেনারা যুকিসা থেকে থেকে যুহুসার দিকে যাত্রা করে। এখান থেকে তারা মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
আবু বকর তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্ট পান এবং তাৎক্ষণিকভাবে মদিনার প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী হন। মূল সেনাবাহিনী উসামার নেতৃত্ব মদিনার বাইরে থাকায় আবু বকর প্রধানত মুহাম্মদ (সা) এর নিজ গোত্র বনু হাশিম থেকে লড়াইয়ের জন্য লোক সংগ্রহ করেন। এই বাহিনী আলি ইবনে আবি তালিব, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ ও জুবায়ের ইবনুল আওয়ামের মত অটল ছিল। এদের প্রত্যেককে নবগঠিত সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদ্রোহীরা কিছু করার পূর্বে আবু বকর তাদের উপর আক্রমণ চালান এবং তাদেরকে যুহুসায় তাদের ঘাটিতে ফেরত পাঠান।
পরের দিন আবু বকর মূল সেনাবাহিনীর সাথে মদিনা থেকে অগ্রসর হন এবং যুহুসার দিকে এগিয়ে যান। আরোহী উটের সবগুলোই উসামার সাথে থাকায় তার সাথে স্বল্প দক্ষতার উট ছিল। সেনারা এই উটগুলোই ব্যবহার করে। এসকল উট যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। বিদ্রোহী নেতা হিবাল মুসলিমদের উপর আচমকা আক্রমণ করলে উটগুলো চমকে যায় এবং মুসলিমদের পিছু হটতে হয়। বিদ্রোহীরা কিছুদিন পূর্বে হারান তাদের ঘাঁটি পুনরায় দখল করে নেয়। মদিনায় আবু বকর পুনরায় সেনাবাহিনী সংগঠিত করেন এবং রাতের বেলা তাদের উপর আক্রমণ করেন। বিদ্রোহীরা যুহুসা থেকে যুকিসার দিকে পিছু হটে। সকালে আবু বকর যুকিসার দিকে সৈন্য চালনা করেন। বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। ৬৩২ সালের ১ আগস্ট যুকিসা দখল করা হয়।
পরাজিত বিদ্রোহী গোত্রগুলো আবরাকের দিকে পিছু হটে। এখানে গাতাফান, হাওয়াজিন ও তায়ি গোত্রের লোকেরা জমায়েত হয়েছিল। বাড়তি সৈনিকদের আন নুমান ইবনে মাকারিনের অধীনে রেখে আবু বকর বাকিদের নিয়ে মদিনায় ফিরে আসেন। ৬৩২ সালের ৪ আগস্ট উসামার বাহিনী মদিনায় ফিরে আসে। তারা ৪০ দিন মদিনার বাইরে ছিল।
আবু বকর উসামার সেনাদের মদিনায় বিশ্রাম নেয়ার আদেশ দেন এবং বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করার জন্য তাদের অস্ত্রসজ্জিত করেন। ইতিমধ্যে ৬৩২ সালের আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবু বকর তার সেনাবাহিনীসহ যুকিসার দিকে অগ্রসর হন। নুমান ইবনে মাকরানের অধীন সেনাদের নিজের কমান্ডে এনে তিনি আবরাকের দিকে অগ্রসর হন। বিদ্রোহীরা পিছু হটে এখানে জমায়েত হয়েছিল। তিনি তাদের পরাজিত করেন। বাকি বিদ্রোহীরা বুজাকার দিকে পিছু হটে। তুলায়হা এখানে তার বাহিনীসহ সামিরা থেকে এসেছিল।
♥আবু বকরের কৌশল
৬৩২ সালের আগস্টের চতুর্থ সপ্তাহে আবু বকর তার সব সেনাদের যুকিসার দিকে যাত্রা করেন। এখানে তিনি আরবের সমগ্র স্থানে ছড়িয়ে থাকা বিদ্রোহীদের সাথে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করেন।[৫] ইতিমধ্যে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি যুকিসা ও আবরাকে তার অংশ নেয়া যুদ্ধগুলো ছিল মদিনাকে রক্ষা ও শত্রুদের আরো এগিয়ে আসা ঠেকানোর জন্য তাৎক্ষণিক লড়াই। এর ফলে আবু বকর সামনে আরো বড় অভিযানের জন্য ভিত্তিভূমি সুরক্ষা করতে সক্ষম হন এবং তার মূল বাহিনীকে চালনার জন্য সময় পেয়ে যান। তার বিরুদ্ধে এসময় বেশ কয়েকজন প্রতিপক্ষ ছিল। এরা হল, বুজাকার তুলায়হা, বুতাহের মালিক বিন নুয়াইরা, ইয়ামামার মুসায়লিমা। আরব পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলে ছড়িয়ে বিদ্রোহকেও তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছিল। এসব স্থান ছিল, ওমান, মাহরা, হাদরামাওত, ও ইয়েমেন। মক্কার দক্ষিণ ও পূর্বের অঞ্চলগুলোতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। উত্তরে কুজার দিকে বিদ্রোহ হয়।
আবু বকর কয়েকটি দল নিয়ে সেনাবাহিনী গঠন করে। খালিদ বিন ওয়ালিদের সেনাদলটি সেনাবাহিনীর মূল ও সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী ছিল। বিদ্রোহীদের শক্তিশালী বাহিনীর সাথে লড়াইয়ের জন্য এদেরকে ব্যবহার করা হয়। বাকি সেনাদলগুলোকে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথমে খালিদের বাহিনী অপারেশনে যেত। অন্যান্য বাহিনীগুলোর অপারেশনের সময় খালিদের বাহিনীর উপর নির্ভর করত। আবু বকরের পরিকল্পনা ছিল মধ্য পশ্চিম আরবকে প্রথমে শত্রুমুক্ত করা, এরপর মালিক ইবনে নুয়াইরার মোকাবেলা করা এবং শেষে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ মুসায়লিমার মোকাবেলা করা।
♥অভিযান
খলিফা ১১টি প্রধান সেনাদল গঠন করেন। প্রত্যেকের একজন করে কমান্ডার ছিল। প্রত্যেক দলকে একটি করে পতাকা দেয়া হয়। হাতে থাকা লোকবলকে এই ১১টি দলে ভাগ করে দেয়া হয়। কোনো কমান্ডারকে তাৎক্ষণিক মিশনে যেতে হলে অন্যদের মিশন পরে পরিচালনা করা হত। সেনাদলগুলোর কমান্ডার ও তাদের দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ,
খালিদ বিন ওয়ালিদ প্রথমে বুজাখার আসাদ গোত্রের তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আল আসদি ও পরে বুতাহর মালিক বিন নুয়াইরা।
ইকরিমা ইবনে আবি জাহল মুসায়লিমার সাথে লড়াই করেন।
আমর ইবনুল আস তাবুক ও দুমাতুল জান্দালের কুজা ও ওয়াদিয়া গোত্রের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
শুরাহবিল ইবনে হাসানা ইকরিমাকে অনুসরণ করেন ও খলিফার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন।
খালিদ বিন সাইদ, সিরিয়ান সীমান্তের কিছু বিদ্রোহী গোত্র।
তুরাইফা বিন হাজিজ, মদিনা ও মক্কার হাওয়াজিন ও বনি সুলাইমের বিদ্রোহী গোত্র।
আলা বিন আল হাদরামি, বাহরাইনের বিদ্রোহী।
হুজায়ফা বিন মিহসান, ওমানের বিদ্রোহী।
আরফাজা বিন হারজামা, মাহরার বিদ্রোহী।
মুহাজির বিন আবি উমাইয়া, ইয়েমেনের বিদ্রোহী, পরে হাদরামাওতের কিন্দার বিদ্রোহী।
সুয়াইদ বিন মুকারান, ইয়েমেনের উত্তরে উপকূলীয় এলাকার বিদ্রোহী।
সেনাদল গঠন সম্পন্ন হওয়ার পর খালিদ এগিয়ে যান। এর কিছু পর ইকরিমা ও আমর ইবনুল আস তাকে অনুসরণ করেন। অন্যান্য সেনাদলগুলো খলিফার অধীনে ছিল। পরের সপ্তাহ ও মাসগুলোতে এদের প্রেরণ করা হয়। শত্রুদের শক্তিশালী অবস্থানের ব্যাপারে খালিদের অপারেশনের উপর এদের প্রেরণ নির্ভর করত।
বিভিন্ন সেনাদলের যুকিসা ত্যাগ করার আগে আবু বকর বিদ্রোহী গোত্রগুলোর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য চূড়ান্ত আহ্বান জানান।
নির্দিষ্ট দায়িত্বের পাশাপাশি কমান্ডারদেরকে নিম্নোক্ত নির্দেশনা দেয়া হয়:
যেসব গোত্র তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের অনুসন্ধান করা।
আজান দেয়া।
গোত্রগুলো যদি আজানের উত্তর দেয় তবে তাদের আক্রমণ করা যাবে না। আজানের পর গোত্রগুলোকে জাকাত প্রদানসহ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে হবে। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে আক্রমণ করা যাবে না।
যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের আক্রমণ করা হবে না।
যারা আজানের উত্তর দেবে না বা আজানের পর পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করবে না তাদের সাথে তলোয়ার দ্বারা ব্যবহার করা হবে।
যেসকল বিদ্রোহী মুসলিমদের হত্যা করেছে তাদের হত্যা করা হবে।
এসকল নির্দেশনাসহ আবু বকর মুসলিম বাহিনীকে ধর্মত্যাগী ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন।
♥মধ্য আরব
মধ্য আরবের বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব ছিল ইয়ামামার উর্বর অঞ্চলের স্বঘোষিত নবী মুসায়লিমা। শক্তিশালী বনু হানিফা গোত্র তাকে সমর্থন করত। উত্তর মধ্য আরবের বুজাখায় আরেকজন স্বঘোষিত নবী বনু আসাদের গোত্রীয় প্রধান তুলায়হা বিদ্রোহ করে ও বনু গাতাফান, হাওয়াজিন ও তায়ি গোত্রের মিত্রতা লাভ করে। নজদে মালিক ইবনে নুয়াইরা বনু তামিম গোত্রের নেতৃত্ব দেয়।
♥বুজাখা
মুসলিমদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে তুলায়হা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। মিত্র গোত্রগুলোও এতে সাহায্য করে। তুলায়হার বিরুদ্ধে খালিদ অগ্রসর হওয়ার আগে আবু বকর প্রতিপক্ষের শক্তি হানি করার পথ খোঝেন যাতে যুদ্ধ সর্বোচ্চ মাত্রার বিজয় অর্জিত হয়। বনি আসাদ ও বনু গাতাফান তুলায়হার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু তায়ি গোত্র তুলায়হার সমর্থনে তেমন এগিয়ে আসেনি। তাদের নেতা আদি ইবনে হাতিম মুসলিম ছিল। আদিকে আবু বকর গোত্রের প্রধানদের সাথে আলোচনা করার জন্য পাঠায় যাতে তারা তুলায়হার বাহিনী থেকে সরে আসে। এই আলোচনা ফলপ্রসু হয়। আদিন তার গোত্রের ৫০০ জন ঘোড়সওয়ার খালিদের বাহিনীতে যোগ করে। খালিদ এরপর আরেক বিদ্রোহী গোত্র জাদিলার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এখানেও আদি ইবনে হাতিম আলোচনার দায়িত্বপালন করেন। বনি জাদিলা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের ১০০০ যোদ্ধা খালিদের সেনাদলে যোগ দেয়। খালিদ এক্ষন বুজাখার দিকে যাত্রা করেন। এখানে ৬৩২ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনি তুলায়হাকে বুজাখার যুদ্ধে পরাজিত করেন। তুলায়হার অবশিষ্ট সেনারা গামরার দিকে পিছু হটে। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে গামরার যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়। খালিদের জয়ের পর কিছু গোত্র আবু বকরের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বুজাখার দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে খালিদ ৬০০০ সৈনিক নিয়ে অক্টোবরে নাকরায় পৌছান। এখানে নাকরার যুদ্ধে খালিদ বিদ্রোহী গোত্র বনু সালিমকে পরাজিত করেন। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে জাফারের যুদ্ধে তিনি গোত্রীয় নেত্রী সালমাকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি নজদের বিদ্রোহী গোত্র বনু তামিমের দিকে অগ্রসর হন।
♥নজদ
বুজাখায় খালিদের বিজয়ের কথা শুনে বনু তামিমের অনেক গোত্র খালিদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এগিয়ে যায় কিন্তু বনু তামিমের একটি শাখা বনু ইয়ারবু তাদের নেতা মালিক ইবনে নুওয়ায়রার অধীনে সরে আসে। মালিক যোদ্ধা, উদার ও কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। সাহসিকতা, উদারতা ও কবিত্ব এই তিনটি গুণ আরবরা সমাদর করত।
মুহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর পর মালিক জাকাত দিতে অস্বীকার করে। মুহাম্মদ (সা) জীবদ্দশায় তাকে বনু তামিমের জাকাত সংগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর খবর শুনে সে জাকাতগুলো গোত্রের লোকেদের দিয়ে দেয়। বুতাহ শহরে তার খালিদ তার লোকদের থামিয়ে জানতে চান যে সে সাজাহর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কিনা। তারা বলে যে এর কারণ তারা তাদের চরম শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায়। খালিদ নজদে পৌছে কোনো বিরুদ্ধ বাহিনী দেখতে পাননি। তিনি তার অশ্বারোহীদের কাছের গ্রামে পাঠান ও তাদের সাথে দেখা হওয়া প্রতি দলের জন্য আজান দেয়ার নির্দেশ দেন। জিরার বিন আজওয়ার মালিকের পরিবারকে গ্রেপ্তার করে দাবি করেন যে তারা আজানের উত্তর দেয়নি। মালিক খালিদের সেনাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে যায় এবং নিজের অনুসারীদের ছড়িয়ে পড়ার আদেশ দেয়। মালিক নিজ পরিবারসহ মরুভূমির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। সে জাকাত দিতে অস্বীকার করে। নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে মালিক বিদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত হয়। একই সাথে স্বঘোষিত নবী সাজাহর সাথে খিলাফতের বিরুদ্ধে মিত্রতার অভিযোগও উঠে। মালিক তার গোত্রীয় লোকসহ গ্রেপ্তার হয়। খালিদ বিন ওয়ালিদ মালিককে তার অপরাধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার উত্তর খালিদের কাছে অপরাধসূচক প্রতীয়মান হওয়ায় খালিদ তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। খালিদের এই আদেশের ফলে এসময় বেশ কিছু বিতর্ক শুরু হয়।
♥ইয়ামামা
অন্যতম সেনা অধিনায়ক ইকরিমা ইবনে আবি জাহলকে মুসায়লিমার সাথে ইয়ামামায় যোগাযোগের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে বলা হয় যাতে খালিদ আসা পর্যন্ত তিনি লড়াইয়ে জড়ান। মুসায়লিমাকে ইয়ামামাতে বাগে আনা আবু বকরের উদ্দেশ্য ছিল। আক্রমণের আশঙ্কায় মুসায়লিমা নিজ ঘাঁটি থেকে বাইরে আসেনি। ইয়ামামা থেকে হুমকি না থাকায় খালিদ উত্তর মধ্য আরবের বিদ্রোহী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে মুক্তভাবে কাজ করতে সক্ষম হন। এরমধ্যে আবু বকর ইকরিমা ইবনে আবি জাহলকে সাহায্য করার জন্য শুরাহবিল ইবনে হাসানাকে প্রেরণ করেন। এরপর আবু বকর খালিদকে আদেশ দেন যেন তিনি মুসায়লিমার বিরুদ্ধে এগিয়ে যান। ইয়ামামায় অবস্থানরত শুরাহবিলের সেনারা খালিদের সহায়তাপ্রাপ্ত হন। অতিরিক্ত হিসেবে আবু বকর বুতাহে খালিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য মদিনায় মুহাজিরিন ও আনসারদের একটি অতিরিক্ত বাহিনী গঠন করেন। বুতাহ থেকে খালিদ ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হন। আবু বকর শুরাহবিলকে নির্দেশনা পাঠান যে খালিদের আসার আগ পর্যন্ত যাতে তিনি মুসায়লিমার সাথে লড়াই শুরু না করেন। খালিদের পৌছানোর কিছু আগে শুরাহবিল আক্রমণ করেন তবে ব্যর্থ হন। ৬৩২ সালের ডিসেম্বরে খালিদ তার সেনাদের নিয়ে শুরাহবিলের সাথে যোগ দেন। সে সপ্তাহে ইয়ামামার দুর্গ নগর আত্মসমর্পণ করে। খালিদ ইয়ামামায় তার সদরদপ্তর স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি ইয়ামামার চারপাশে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ফলে সমগ্র মধ্য আরব মদিনার কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাকি অঞ্চলগুলো মুসলিমরা পাঁচ মাসের মধ্যে পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে মূলোৎপাটন করে।
♥ওমান
৬৩২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে আবু বকর হুজায়ফা বিন মিহসানকে ওমানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এখানে ওমানের সংখ্যাগুরু গোত্র আজদ তাদের নেতা লাকিত বিন মালিকের অধীনে বিদ্রোহ করে। কিছু সূত্র মতে সেও নিজেকে নবী দাবি করে। হুজায়ফা ওমানে প্রবেশ করেন। লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট সেনা না থাকায় তিনি সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং খলিফাকে এ ব্যাপারে চিঠি লেখেন। সেপ্টেম্বরের শেষভাগে খলিফা ইকরিমাকে তার সাহায্যার্থে পাঠান। ইকরিমা ইয়ামামা থেকে ওমানের দিকে যাত্রা করেন। তাদের সম্মিলিত বাহিনী দাবার যুদ্ধে লাকিত বিন মালিককে পরাজিত করে। লাকিত বিন মালিক যুদ্ধে নিহত হয়।
এরপর হুজায়ফা ওমানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আইন শৃঙ্খলয়া পুনপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। ইকরিমার কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। তিনি তার বাহিনী নিয়ে পার্শ্ববর্তী দাবা অঞ্চলে যান এবং আজদ গোত্রের যারা বিদ্রোহী ছিল তাদের পরাজিত করেন।
♥উত্তর আরব
৬৩২ সালের অক্টোবরে আমরের বাহিনী সিরিয়ার সীমান্তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়। এদের মধ্যে তাবুক ও দুমাতুল জান্দালের কুজা ও ওয়াদিয়া (বনি কালবের শাখা) গোত্র গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে ইয়ামামার যুদ্ধের পর জানুয়ারিতে শুরাহবিলের আসার আগ পর্যন্ত আমর তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হননি।
♥ইয়েমেন
ইয়েমেন প্রথম ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের নেতা আল আসওয়াদ নিজেকে নবী ঘোষণা করেছিল। পরে মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশায় ফাইরুজ আল দাইলামি তাকে হত্যা করেন। ফাইরুজ এরপর সানায় ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ইয়েমেনে আবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। এসময় কাইস বিন আবদ ইয়াগুস নামক এক ব্যক্তি এসময় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। মুসলিমদের ইয়েমেন থেকে বের করে দেয়া বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল। তারা ফাইরুজ ও অন্যান্য মুসলিম নেতাদের হত্যার মাধ্যমে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্য করার উদ্যোগ নেয়। ফাইরুজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং পার্বত্য এলাকায় আশ্রয় নেন। ৬৩২ সালের জুলাইয়ে এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তী ছয় মাস এখানে অবস্থান করেন। পরে ইয়েমেন থেকে আসা কয়েক হাজার মুসলিম তার সাথে যোগ দেয়।
নিজের অবস্থান শক্ত হওয়ার পর ফাইরুজ তার লোকদের নিয়ে কাইসের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি সানার বিরুদ্ধে এগিয়ে যান ও কাইসকে পরাজিত করেন। কাইস তার লোকদের নিয়ে উত্তর পূর্বে আবয়ানে চলে যায়। সেখানে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং খলিফা তাদের ক্ষমা করে দেন।
♥মাহরা
আবু বকরের আদেশের পর ইকরিমা আরফাজা বিন হারসামার সাথে যোগ দেয়ার জন্য ওমান থেকে মাহরার দিকে অগ্রসর হন। আরফাজা তখনও না পৌছায় ইকরিমা তার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে স্থানীয় বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করেন।
জাইরুত নামক স্থানে ইকরিমা দুইটি বিদ্রোহী সেনাদলের মুখোমুখি হন। তাদের একটিকে তিনি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা তা গ্রহণ করে তার সাথে যোগ দেয় ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়। মাহরায় ইসলাম পুনপ্রতিষ্ঠার পর ইকরিমা তার সেনাদের নিয়ে আবয়ানের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তিনি তার সেনারা বিশ্রাম নেয় ও পরবর্তী কাজের জন্য অপেক্ষা করে।
♥বাহরাইন
ইয়ামামার যুদ্ধের পর আবু বকর উলা বিন আল হাদরামিকে বাহরাইনের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। উলা হাজরে জমায়েত হওয়া বিদ্রোহীদের খুজতে বাহরাইনে পৌছান। উলা এক রাতে আচমকা হামলা চালান ও শহর অধিকার করে নেন। বিদ্রোহীরা উপকূলের দিকে পিছু হটে। তারা আরো একবার লড়াই করে তবে পরাজিত হয়। অধিকাংশ আত্মসমর্পণ করে ও ইসলামে ফিরে আসে। ৬৩৩ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে এই অপারেশন সমাপ্ত হয়।
♥হাদরামাওত
সর্বশেষ বড় বিদ্রোহটি পূর্ব ইয়েমেনের হাদরামাওতের নাজরানের অধিবাসী কিন্দা গোত্র কর্তৃক সংঘটিত হয়। ৬৩৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তারা বিদ্রোহ শুরু করেনি। হাদরামাওতের মুসলিম গভর্নর জিয়াদ বিন লুবাইদ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এরপর কিন্দার লোকেরা পরিপূর্ণভাবে বিদ্রোহ শুরু করে। আশাস বিন কাইস তাদের নেতা ছিল। দুপক্ষের সেনাসংখ্যা ভারসাম্য অবস্থায় ছিল বিধায় ব্যাপক লড়াই শুরু করতে কেউ আগ্রহী ছিল না। জিয়াদ সাহায্য আসার অপেক্ষা করতে থাকেন। আবু বকরের প্রেরিত সেনাদলের কমান্ডার মুহাজির বিন আবি উমাইয়া নাজরানের কিছু বিদ্রোহী গোত্রকে দমন করেন। তার বাহিনীকে হাদরামাওতে জিয়াদের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। খলিফা ইকরিমাকে আদেশ দেন যাতে তিনি জিয়াদ ও মুহাজিরের সাথে যোগ দেন। ৬৩৩ সালের জানুয়ারি মুহাজির ও জিয়াদের সেনারা হাদরামাওতের রাজধানী জাফারে মিলিত হয়। তারা আশাসের বাহিনীকে পরাজিত করে। আশাস নুজাইরের দুর্গ শহরে পিছু হটে। যুদ্ধের পর পর ইকরিমা পৌছান। মুহাজিরের সার্বিক কমান্ডের অধীন তিনটি মুসলিম সেনাদল নুজাইরের দিকে অগ্রসর হয় ও শহর অবরোধ করে। ৬৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে নুজাইর দখল করা হয়। এর মাধ্যমে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আরব পুনরায় ইসলামের অধীনে আসে। হিজরতের ১১তম বছরে বিদ্রোহ সংঘটিত ও দমন করা হয়। ৬৩৩ সালের ১৮ মার্চ ১২ হিজরিতে সমগ্র আরব খলিফার একক নেতৃত্বের অধীনে আসে। এই অভিযান আবু বকরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয় ছিল।
♥পরবর্তী প্রভাব
বিদ্রোহীদের পরাজয় ও সমগ্র আরবের একক কর্তৃপক্ষের অধীনে আনার পর মুসলিমরা বাইরের দিকে মনোনিবেশ করে। এরপর পারস্যে মুসলিমদের বিজয় সূচিত হয়। খালিদকে ১৮,০০০ সৈনিকসহ পারস্যের সম্পদশালী প্রদেশ ইরাক জয়ের জন্য প্রেরণ করা হয়। ইরাকের সফল অভিযানের পর আবু বকর রোমান সিরিয়া জয়ের জন্য তাকে নির্দেশ দেন। এটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান প্রদেশ ছিল।
No comments
Thanks for your comments. I will reply you as soon as.