শিরোনাম

ভোট দেওয়ার কার্যকর পথ খুঁজতে হবে

গত ৮ এপ্রিল ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) উদ্যোগে সিরডাপ মিলনায়তনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘ভোটাধিকার প্রবর্তন: সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। আরও ছিলেন বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান ও সরকারি দলের সাংসদ ফারুক খান। ছিলেন বেশ কয়েকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও অন্যরা। আমিও ছিলাম আমন্ত্রিত অতিথি। মূল প্রবন্ধটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছিলেন ইডব্লিউজির পরিচালক আবদুল আলীম। ওই উপস্থাপনায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেটাই ছিল মূল উপাত্ত। ওই আলোচনায় ভোটার নিবন্ধন এবং ভোট প্রদানের চারটি প্রক্রিয়ার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে প্রতিটি প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়েও আলোচনা হয়।
ওই সেমিনারেই ঘোষণা আসে, একই বিষয়ে একটি সেমিনার নির্বাচন কমিশন আয়োজন করবে, এ বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা নির্ণয় করার জন্য। সে অনুযায়ী কমিশন গত ১৯ এপ্রিল একই বিষয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে পূর্ণ কমিশনসহ উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। নির্ধারিত বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইতালি, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি।
ওই সেমিনার দুটিতেই প্রবাসীদের ভোট প্রদানের যে চারটি প্রক্রিয়া আলোচিত হয়েছিল, সেগুলো ছিল ব্যক্তিগত উপস্থিতি ভোট (দেশে বা বিদেশে), পোস্টাল ব্যালট, যা বর্তমানে বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁরা নিজেদের ভোটকেন্দ্র থেকে বাইরে কর্মরত এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য রয়েছেন। বাকি দুটি প্রক্রিয়া প্রক্সি ভোট, যা বাংলাদেশের আইনে নেই এবং ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের মাধ্যমে, যা এখনো বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়নি। পোস্টাল ব্যালট আগাম ভোটের একটি প্রক্রিয়া। দেশের বাইরে থাকা বিশাল সংখ্যার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য উল্লিখিত প্রক্রিয়ার, প্রক্সি ভোট ছাড়া, প্রয়োজন দূতাবাসের সম্পূর্ণ সহযোগিতা, তবে সব প্রক্রিয়াই জটিল।
তবে নির্বাচন কমিশনের এই সেমিনারের বিষয় একটু ভিন্নতর ছিল। বিষয়টি ছিল ‘প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকগণকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটাধিকার প্রয়োগসংক্রান্ত সেমিনার’। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন জাতীয় পরিচয়পত্র উইংয়ের মহাপরিচালক। ইডব্লিউজি এবং নির্বাচন কমিশনের দুটি উপস্থাপনা প্রায় কাছাকাছি। এ বিষয়ের ওপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিষয়ের ওপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রদূতেরাও তাঁদের মন্তব্য তুলে ধরেন। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তিনজন রাজনৈতিক সদস্যও। তবে সম্পূর্ণ আলোচনার বেশির ভাগজুড়ে ছিল জাতীয় পরিচয়পত্রকেন্দ্রিক। অথচ আমার মতে, মূল বিষয় হওয়া উচিত ছিল কীভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হবে এবং কোন প্রক্রিয়ায়। কারণ, পরিচয়পত্র ভোটার হওয়ার সঙ্গে যুক্ত। এখনো শুধু ভোটারদেরই পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, বেশির ভাগ আলোচকই পরিচয়পত্র প্রদানকে আলাদাভাবে দেখেছেন।
যা-ই হোক, রাষ্ট্রদূতদের আলোচনায় উঠে আসে ভোটার নিবন্ধনের বিষয়টিও। এখানে বলে রাখা ভালো, সরকারিভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা না হলেও বেসরকারিভাবে অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার কার্যত বাধ্যতামূলক। সেই বিবেচনায় গত ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রবাসী সব নাগরিকেরই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা। তবে মূল বিষয়টি হলো, কীভাবে বাংলাদেশি প্রবাসী নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রদানের বিষয়ে এ ধরনের মতৈক্য রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অবশ্যই ভোটার হওয়ার সঙ্গে যুক্ত। কাজেই নতুনভাবে হয়তো খুব বেশিসংখ্যক নাগরিককে ভোটার করতে হবে বলে মনে হয় না।
প্রবাসী নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদানের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদেও স্বীকৃতি রয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ অধিকার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে নেপালে বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত অগ্রগামী। অনেক বছরের প্রয়াস এবং ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালতের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে লোকসভায় বিল পাস হয়। এ বিলের আওতায় রিপ্রেজেন্টেশন পিপলস অ্যাক্টে (আরপিএ) প্রক্সি ভোটের আওতায় ভারতের বাইরে প্রায় দুই কোটি প্রবাসী ভারতীয়ের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে, যা আগামী নির্বাচনে প্রয়োগ হওয়ার কথা। ভারতে সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইন প্রয়োগ সংস্থার জন্য প্রক্সি ভোটের ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন মনে করেছে, ‘প্রক্সি’ ভোটই সবচেয়ে কার্যকর ও উত্তম প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট প্রদান নিশ্চিত করা সহজতর হবে। এ সিদ্ধান্ত অন্যান্য প্রক্রিয়ার চেয়ে সহজতর। উল্লেখ্য, ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান নেই। পাকিস্তানে উচ্চতর আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পোস্টাল ব্যালটের একটি ‘মহড়া’ করেছিল। এতে দেখা যায়, পোস্টাল ব্যালট সময়মতো পৌঁছায়নি এবং এই প্রক্রিয়া বেশ জটিল। তবে এখন চূড়ান্তভাবে প্রক্রিয়া গৃহীত হয়নি।



আমাদের দেশে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন নিজ উদ্যোগে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আইনি কাঠামো তৈরি করলেও ভোট প্রদানের নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। ২০১২ সালের পরবর্তী কমিশন এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রসর হয়নি, যা এখন বর্তমান নির্বাচন কমিশন হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও কয়েকটি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রবিধান থাকলেও সংবিধানের ধারায় (আর্টিকেল) ৬৬ (১) একজন ব্যক্তি নির্বাচনের উপযুক্ত হবেন, যদি তিনি শুধু বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন। ওই ধারায় দ্বৈত নাগরিকের বিধান নেই। অতীতে আইনের ফাঁকফোকরে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেও বিদেশি নাগরিকত্ব বর্জন করতে হয়েছে। নির্বাচনে অযোগ্য হলে যৌক্তিক কারণে ভোটার হতেও বাধা থাকার কথা। কাজেই দ্বৈত নাগরিকদের ভোটার হওয়া এবং ভোট প্রদানের আপাতদৃষ্টে কোনো আইনি বিধান নেই। এমনটি করতে হলে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন হবে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, প্রায় এক কোটি নাগরিক দেশের বাইরে কর্মরত অথবা কাজের খোঁজে রয়েছেন। তাঁদের সিংহভাগ মধ্যপ্রাচ্যে ও মালয়েশিয়াতে। বেশ বড়সংখ্যক রয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যার মধ্যে ইতালি অন্যতম। এসব প্রবাসীকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-বৈধ প্রবাসী, অন্য নামে বিদেশে কর্মরত প্রবাসী এবং অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসী। অবৈধ অথবা অন্য নামে বসবাস বা কর্মরত নাগরিকদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করা এবং ভোট প্রদানের বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। এ অবস্থা অবশ্য যেকোনো প্রক্রিয়াকে জটিল করবে। এ বিষয়গুলো অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে।
বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় সংযুক্ত হওয়া এবং ভোট প্রদানের বিদ্যমান আইনে দেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ ঠিকানায় ভোট প্রদানের ব্যবস্থাই রয়েছে। কাজেই যেসব প্রবাসী ভোটার হতে অথবা ভোট প্রদানে আগ্রহী, তাঁদের অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে নিজ নিজ এলাকায় সশরীরে উপস্থিত থেকেই ভোট প্রদান করতে হবে। এর বিকল্প পোস্টাল ভোট সীমিত রয়েছে মাত্র, যার প্রয়োগও আজ পর্যন্ত করা তেমনভাবে সম্ভব হয়নি।
শুরুতে যে দুটি সেমিনারের কথা বলেছি, সেখানে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অভিন্ন চারটি প্রক্রিয়াই তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলোর যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা দরকার। প্রথমত, ব্যক্তিগতভাবে ভোট প্রদান। এ প্রক্রিয়াটি বিদেশে অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে। বিশেষ করে, বিদেশে প্রচারণা এবং ভোট দেওয়ার সময় সম্ভাব্য সহিংসতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব বিদেশে পড়তে বাধ্য। দ্বিতীয়টি পোস্টাল ব্যালট, যা বহু ধরনের জটিলতার জন্ম দেবে। প্রধান সমস্যা হবে হাজার হাজার পোস্টাল ব্যালট ভোট গণনার আগে নির্দিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছানো। পাকিস্তানের মহড়া ভোটে এই সমস্যার কারণেই এ প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন উৎসাহিত হয়নি ওই দেশের নির্বাচন কমিশন। ইলেকট্রনিক ভোটিং প্রক্রিয়া দেশেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, এ প্রক্রিয়া নিয়ে এ সময়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না।
যদিও প্রক্সি ভোটের বিধান বাংলাদেশে এখনো নেই, তবে এই প্রক্রিয়াই যথেষ্ট সহজ উপায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর এ প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা। ভারতে বহু বছরের গবেষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো সহমত হয়ে বিল পাস করেছে। ভারতের এ অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশন এ প্রক্রিয়ার ওপর আরও বিশদ গবেষণা করতে পারে। আমি মনে করি, এ প্রক্রিয়া সহজ, কম জটিল এবং কম খরচে হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন হবে আইনে প্রক্সি ভোটের বিধান রাখা এবং বিধি দ্বারা এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিধান করা।
আমি মনে করি, প্রবাসীদের অবশ্যই ভোটাধিকার দিতে হবে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় এবং বিদ্যমান প্রক্রিয়াগুলোর বিশ্লেষণ ও কিছু গবেষণার প্রয়োজন। এমনটা করতে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনবিশেষ ছোট আকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে আরও বিস্তারিত গবেষণা করা। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রক্রিয়াটি নির্ধারণ করা। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল, কাজেই সেভাবেই কমিশনকে সময় নিয়ে এগোতে হবে।================================================================================================================================================================================================================ (My Facebook Page = www.facebook.com/AbdullahIbneMasud5) (My blog site = www.AbdullahIbneMasud5.blogspot.com) (My Facebook group = www.facebook.com/groups/AbdullahIbneMasud5)

No comments

Thanks for your comments. I will reply you as soon as.