সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরই পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে।
শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপনে দুই দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হলেও এখনো পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং পাহাড়ে হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, বেপরোয়া চাঁদাবাজিসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে।
‘অধিকার আদায় আর মুক্তির সংগ্রাম’- এই স্লোগান সামনে রেখে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনগুলোর সশস্ত্র হুমকির মুখে অসহায় সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিসহ সব পেশাজীবী।
সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটলো তা আরও ভয়াবহ। রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা পরিষদ এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয় খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য, নানিয়াচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শক্তিমান চাকমা।
তার শেষকৃত্যে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে মারা যায় বিভিন্ন পাহাড়ি সংগঠনের চার নেতা ও একজন মাইক্রোবাসচালক নিরীহ বাঙালি সজিব।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতি সংস্কারবাদী (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলে এর বিরোধিতা করে প্রসিত চাকমার নেতৃত্বাধীন একদল পাহাড়ি ছাত্র ও যুবক। পরে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
এরপর দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে বিভক্তি দেখা দেয় জনসংহতি সমিতির মধ্যে। ২০০৭ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা, শক্তিমান চাকমা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমাসহ কিছু নেতাকর্মীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) দল।
সর্বশেষ ইউপিডিএফ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। এসব দলের নেতাকর্মীরা মরিয়া পাহাড়ে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এ নিয়ে চলছে খুনের বদলা খুন।
তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা ছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রভাবশালী শীর্ষনেতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের জেরে দল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে।
এরপর মূল সংগঠন ভেঙে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর তার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামে আরেক পাল্টা সংগঠন।
সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের মাত্র ২০ দিনের মাথায় ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়াচরে সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউপিডিএফ নেতা অনাদি রঞ্জন চাকমাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর ১০ দিনের ব্যবধানে ১৫ ডিসেম্বর রাতে নানিয়াচরের সীমান্তে বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ধামাইছড়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের সংগঠক অনল বিকাশ চাকমা ওরফে প্লুটোকে।
এরপর ইউপিডিএফের সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুন চাকমাকে খাগড়াছড়িতে হত্যাসহ তাদের আরও কয়েক সদস্য ও সমর্থককে খুন করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা বলছে, মূলত চাঁদার লোভেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের আড়ালে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক দলগুলো।
চাঁদার রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারের নেশায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বরাবরই বদ্ধ উন্মাদ। হিংসা-হানাহানি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য অব্যাহত রেখেছে সব কটি সংগঠন। থেমে নেই নিজেদের মধ্যে সংঘাত।
সন্ত্রাস দমনে পার্বত্যাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাবাহিনী যথেষ্ট তৎপর। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে বেশির ভাগ সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় এসব সন্ত্রাসী সংগঠন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর থেকে এই অঞ্চলে খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
No comments
Thanks for your comments. I will reply you as soon as.